উচ্চশিক্ষা কেনো দরকার?

 উচ্চশিক্ষা কেন প্রয়োজন?


বিদেশে কোথায় কোথায় স্কলারশিপ দেয়, সেগুলো পেতে হলে কি কি যোগ্যতা লাগে, কি প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে আগাতে হবে এসব নিয়ে অনেক লেখা এবং আলোচনায় হয়েছে তারপরও কেন জানি মনে হয় প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য আসার কথা বা আসা উচিৎ প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে শতগুণে কম। আমি মনে করি এই সমস্যার মুল কারণ হল মাইন্ডসেট। ইদানিং তরুণ প্রজন্ম এবং ইউনিভার্সিটি ও কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে বিসিএস এর ক্রেজ অনেক বেশি। তাছাড়া দেশে চাকরি নেই, কোটা, দুর্নীতি এগুলো নিয়ে যেখানে হতাশার অন্ত নেই সেখানে আমার কোনোভাবেই বুঝে আসেনা উচ্চশিক্ষার প্রতি আমাদের এত আগ্রহ কম কেন! এখানে তো কোটা, দুর্নীতি নেই বললেই চলে সাথে যদি বলেন সুযোগ কেমন তাহলে আমি বলব অসীম। এই অসীম সুযোগ কাজে লাগাতে হলে আমাদের সবার আগে যেটা দরকার সেটা হল মাইন্ডসেট অর্থাৎ আপনাকে ডিটারমাইন্ড হতে হবে যে আপনি বাইরে পড়তে যাবেন। কিন্তু সেই ডিটারমিনেশন আনতে হলে আপনি যেটা করছেন বা করতে যাচ্ছেন সেটা সম্পর্কে আপনার সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। যেকোনো ক্ষেত্রে সফল হতে হলে এটাই হল কি। 


আমাদের দেশের ছাত্র ছাত্রী দের মুল সমস্যা হল আমরা অত্যধিক আবেগ নির্ভর, অন্যভাবে বললে এখানে অধিকাংশ ছাত্র ছাত্রী মোটেও চিন্তাশীল না বা দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করেনা। কয়েকটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা কিছুটা স্পষ্ট হবে। যেমন ধরেন ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় সবাই চায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে কলেজে ( ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে) পড়ার কথা বললে হয়ত অনেকে অপমান বোধ করতেও দেখা যায়। এটাকে আমি খারাপ ভাবে দেখছি না কিন্ত যারা স্বপ্ন দ্যাখে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার তাদের ভিতর কতজন একটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ভিতর পার্থক্য বোঝে বা চিন্তা করে? সাধারণ কলেজ থেকে একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে যে জিনিস টা পার্থক্য সৃষ্টি করে সেটা হল একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম কাজ হল নতুন জ্ঞ্যান তৈরী করা। আর এই নতুন জ্ঞ্যান সৃষ্টির একমাত্র উপায় হল গবেষণা এবং উদ্ভাবন। 


বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিপুল সংখ্যক ছাত্র ছাত্রী প্রতিবছর ভর্তি হয় তাদের ভিতর সবচেয়ে মেধাবী মানুষ গুলো যায় উচ্চশিক্ষায় আর বাকিরা দক্ষ শ্রমিক হিবেসে বাজারে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সিটের বিপরীতে ৬০-৭০ জন করে প্রতিযোগিতা করে সুতরাং আমি নিঃসন্দেহে বলব এখানে যারা ভর্তি হয় সবাই আউটস্টান্ডিং কিন্তু আমাদের নিম্নমুখী চিন্তাভাবনা আমাদের ছোট করে রাখে। এখানে সবাই প্রতিযোগিতা করে দক্ষ শ্রমিক হবার বা রাষ্ট্রীয় চাকর হবার কিন্তু কেউ স্বপ্ন দেখে না এমন কোনো মানুষ হওয়ার যে তার গবেষণা এবং উদ্ভাবনের দ্বারা সারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে। এখন বলতে পারেন ভাই কাউকে না কাউকে ও সে কাজগুলো করতে হবে। হ্যাঁ অবশ্যই যেমন আপনার জুতা সেলাই করার জন্যও তো একজন লাগবে তাহলে আপনি সেটা হতে চান না কেন? এখানে আসল পয়েন্ট হল আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী স্বপ্ন দেখেন এবং নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে জানুন। আপনার ছোট স্বপ্নই আপনাকে ছোট করে রাখছে। 


এখন প্রশ্ন আসতে পারে উচ্চশিক্ষার সুযোগ কি সীমাহীন?


এই প্রশ্নের উত্তর হল হ্যাঁ। কিন্তু এটা অনুধাবন করতে হলে কয়েকটি বিষয় একটু স্ববিস্তারে আলোচনা করতে হবে। যেমন- বিজ্ঞানী বা গবেষকেরা তাদের চাকরির জন্য কারোর মুখাপেক্ষী থাকেনা বরং তারা তাদের নিজের জব নিজেরা তৈরী করে। কেমন করে সম্ভব সেটা? গবেষকদের বা বিজ্ঞনীদের সার্বিক কাজের ভিতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হল গবেষণার টাকা বা ফান্ড নিয়ে আসা। সেটা নিয়ে আসতে হয় সরকারী বে-সরকারী বিভিন্ন সংস্থা থেকে। সেটা করার একটা লিনিয়ার উপায় হল আপনাকে একটা সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে এবং সিস্টেম্যাটিক উপায়ে তার একটা সমাধান দেওয়ার কথা বলতে হবে।যেমন ধরেন- ডায়াবেটিস একটা সমস্যা। এটা নিয়ে আপনি আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ বরাবর লিখলেন এখন আমেরিকাতে ৩০ মিলিয়ন লোকের ডায়াবেটিস যার পিছলে বার্ষিক খরচ ৩০০ বিলিয়ন ডলার। আমাকে যদি ১ মিলিয়ন টাকা দাও তাহলে আগামী ৫ বছর ধরে আমি একটা গবেষণা করব যার ফলে ডায়াবেটিস এর একটা ভালো ওষুধ তৈরী হতে পারে বা এই রোগের মেকানিজম সম্পর্কে আমরা আরো অনেক কিছু জানতে পারব যেটা ভবিষ্যৎ গবেষণার পথ উন্মুক্ত করবে। তেমনি ভাবে যারা আপনি একটা অটোমোবাইল কোম্পানীর কাছে লিখতে পারেন যে আমার কাছে এমন একটা আইডিয়া আছে যে আমি একটা ইঞ্জিন বানাতে পারব যেটা ১ লিটার তেলে ২০ মাইল চলবে যেখানে বর্তমান ভার্সন ১৫ মাইল চলে। সুতরাং তোমরা যদি এই টেকনোলজি ব্যবহার কর তাহলে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবা। কিন্তু আপনি যে লিখলেই আপনাকে টাকা দিয়ে দিবে এরকম ভাবার কিছু নেই। আপনার প্রস্তাব টা তাদের কাছে বিশ্বাস যোগ্য হতে হবে যেমন ধরুন প্রথমে আপনার যোগ্যতা যেটা বোঝার উপায় হল আপনি ঐ এরিয়াতে আগে কি ধরনের কাজ করেছেন এবং সেখানে আপনার সফলতা কেমন। যেমন আপনার কাজ কি কি ধরনের জার্নালে পাবলিশ করেছেন এবং তার ইমপ্যাক্ট কেমন। আপনি কিভাবে কাজটি সম্পন্ন করবেন তার একটা বিস্তারিত বর্ননা যেটা পরে আবার অন্যান্য বিজ্ঞানীরা পড়ে যাচাই করবেন। এবার আপনি যে ১ মিলিয়ন ডলার তাদের কে দিতে বলবেন সেখান থেকে কিছুটা আসবে আপ্নার বেতন, কিছুটা আসবে আপনার আন্ডারে যারা কাজ করবেন তাদের বেতন আর কিছুটা গবেষণার খরচ। 


এভাবেই সমস্যা চিহ্নিত করা, সেটা সমাধানের প্রস্তাব লিখে টাকা নিয়ে এসে বিজ্ঞানীরা তাদের নিজেদের বেতনের টাকা এবং তাদের আন্ডারে যারা কাজ করে যেমন- পোস্টডক, পিএইচডি স্টুডেন্ট, গবেষণা সহকারী – তাদের জব তৈরী করেন। যারা এখন পোস্টডক বা পিএইচডি করছেন তারাও আবার একসময় স্বনির্ভর গবেষক হয়ে গড়ে উঠবেন। আর এই প্রক্রিয়া টা চলতে থাকে এজন্য পৃথিবীতে মানুষের সমস্যা বা চাহিদার কোনো অন্ত নেই। একটা সমস্যা সমাধানের সাথে সাথেই বা একটা চাহিদা মেটানোর সাথে সাথেই তৈরী হয় আরেকটা সমস্যা বা চাহিদা। যেমন একসময় লাখে লাখে মানুষ মারা যেত ডায়রিয়া, কলেরা, বসন্ত, টায়ফয়েডের মত রোগে। তখন মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪০-৫০ বছরের মত। বিজ্ঞানীরা সেগুলোর সমাধান করেছেন সাথে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে এখন হয়েছে ৭০-৮০ এর মত কিন্তু উদ্ভব হয়েছে নতুন সমস্যা যেমন- ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিজ, ক্যান্সার, আলঝেইমার্স ডিজিজ ইত্যাদি। আগে যেখানে মানুষ হজ্ব করতে যেতেন পায়ে হেটে বা জাহাজে চড়ে সেখানে এখন ৫ ঘন্টায় পৌছে যান কাবা শরীফে। আগে জমিদারেরা বাসায় পেয়াদা রাখত তাদের কে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করার জন্য এখন সেখানে বাড়ি বাড়ি এয়ার কন্ডিশন। আর এই সব পরিবর্তন এসেছে একমাত্র গবেষণা এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে। আর এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছে বিজ্ঞানী আর গবেষকেরা যেটা হওয়ার একমাত্র উপায় হল উচ্চশিক্ষা এবং ডেডিকেশন। একজন মানুষ হিসেবে এই পরিবর্তনে অংশ নিতে পারাটাই কি সার্থকতা নাকি লোকদেখানো ভোগবিলাসী একটা জীবন যাবন আর একরাশ হতাশা আর অপূর্নতা নিয়ে মরে যাওয়া আর মহাকালের স্রোতে হারিয়ে যাওয়াটায় সার্থকতা? 


আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে কিন্তু কোন বৈশিষ্ট তাকে সৃষ্টির সেরা জীবে পরিনত করেছে সেটা ভেবে দেখেছেন একবার? আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন তার নিজের কিছু গুণ যেমন আল্লাহ সৃষ্টিশীল এবং তিনি মানুষকে তৈরী করেছেন সৃষ্টিশীল জীব হিসেবে যে তার নিজের সৃষ্টির মাধ্যমে নিজের অবস্থানের পরিবর্তন করে। আর তাই তো একসময়ের আদিম গুহাবাসী মানুষ আজকের আধুনিক মানুষ! আর আপনার আমার এই আধুনিক মানুষ হওয়ার নেপথ্যে কারা? যারা সৃষ্টির উন্মাদনায় নিজের জীবন যৌবন উৎসর্গ করেছেন তারা নয় কি? 

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারে তাহলে সবাই তো নতুন জিনিস সৃস্টহি করেনা বা বিজ্ঞানী না তাহলে বাকিদের আল্লাহ কেন সৃষ্টি করেছে? এই প্রসঙ্গে আমি প্রায়ই একটা উদাহরণ দেই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য আল্লাহ সবকিছুই প্রকৃত উদ্দেশ্য যে পরিমাণ দরকার তার চেয়ে অনেক বেশি সৃষ্টি করেছেন যেমন ধরেন- স্পার্ম, পরাগরেনু, বা বর্ষাকালে দেখবেন জাম গাছের নীচে হাজার হাজার চারা কিন্তু বৃক্ষে পরিনত হয় কয়টা? যাহোক অনেক ফিলোসোফিকাল কথা বলে ফেললাম কিন্তু মাইন্ডসেটের জন্য এগুলো আমাকে অনেক হেল্প করেছে। 


সফল হওয়ার পূর্বশর্ত হল মাইন্ডসেট করা, নিজের উপর আস্থা রাখা আর নিজেকে প্রতিনিয়ত সবচেয়ে বড় জায়গায় কল্পনা করা। আর সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল আপনি কি করবেন, কেন করবেন, ১০ বা ১৫ বছর পর সেটা আপনাকে কোথায় নিয়ে যাবে, সেটা আপনার বাকি লাইফ বা নেক্সট জেনারেশনের উপর কি কি প্রভাব ফেলবে এগুলোর ব্যাপারে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। আরেকটা খুব ই গুরত্বপূর্ন বিষয় হল প্রতিনিয়ত নিজেকে যাচাই করা। আপনার লক্ষ্যে পৌছাতে হলে কি কি করতে হবে তার কতটুকু আপনি করছেন বা ৭ দিনের, ১৫ দিনের বা ৩০ দিনের একটা লক্ষ্য নির্ধারন করা এবং সেই সময় পরে কতটুকু প্রগ্রেস সেটা যাচাই করা। 

কারো নির্দিস্ট কোনো বিষয়ে আগ্রহ থাকলে কমেন্টে লিখতে পারেন। পরের লেখায় কাভার করার চেষ্টা করব। 


মোঃ তরিকুল ইসলাম

পিএইচডি ছাত্র

ডিপার্ট্মেন্ট অব নিউট্রিশন এন্ড ইন্টিগ্রেটিভ ফিজিওলজি 

ইউনিভার্সিটি অব ইউটাহ


Post a Comment

0 Comments