চাকরি, উচ্চশিক্ষা ও পারিবারিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা

 প্রসংগ : চাকরি,  উচ্চশিক্ষা ও পারিবারিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় সব আর্থিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে কিন্তু চান্স পাওয়ার পর যখন রেজাল্টের দিক থেকে প্রথম সারির সিজিপিএ ধারীদের তালিকা দেখবো, বেশিরভাগই আর্থিক ভাবে বেশ স্বচ্ছল পরিবারের।  আমি নিজেও তার ব্যতিক্রম নই।  

মানুষ দেখেছে আমি প্রচুর কম্পিটিশন জিতেছি,ন্যাশনাল  ইনভায়রনমেন্ট অলিম্পিয়াড এর নেতৃত্বে ছিলাম,  ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিলাম।   কিন্তু,  আমি অনার্স লাইফে একটা সিংগেল টিউশনি করাই নি। 


অনার্স শেষে আমি চাকরির প্রিপারেশন ধরার পর মাঝে মাঝে ১৮ ঘন্টাও পড়া নিয়ে এক্টিভ থেকেছি।  একবার আমার একাডেমিক ডিপার্টমেন্ট এর একটা ঘটনায় চেতে যেয়ে টানা ৭ দিন ১৬ ঘন্টা এভারেজে পড়েছি। 

টিউশনি করা লাগে নি,  আর্থিক চিন্তা করা লাগে নি। 


আমি মাত্র ৩ মাস প্রিপারেশনে দুদকে চাকরি পেয়েছি বলা যায়৷  কিন্তু আমি ৩ মাসে যা পড়তে পেরেছিলাম মাস্টার্সের ক্লাস করেও তা অনেকের ১২ মাসের প্রিপারেশনের সমান।  ( আবার প্রথম বিসিএস প্রিলির জন্য প্রায় ১৬ মাস প্রিপারেশন নিয়েছি করোনার সুবাদে)  


কিন্তু,  আমার সহপাঠীদের একটা বড় অংশের এই সুযোগ ছিলো না।   তাদের অর্থনৈতিক কারনে টিউশনি করতে হয়েছে। 

তাদের ঢাকার জ্যাম সহ্য করতে হয়েছে।  হলের বাজে খাবার সহ্য করতে হয়েছে। লাইব্রেরিতে সিট দখল করতে যুদ্ধ করতে হয়েছে। 


নিজের উদাহারণ আগে টানলাম কারন আমি স্ট্রাগলের গল্প ফাঁদলে সেটা নির্জলা মিথ্যা হবে৷  আমি আমার শরীরের বারোটা বাজিয়ে পড়লেও আমাকে বই কেনা নিয়ে চিন্তা করতে হয় নি।  

মা বাবাও শিক্ষিত হবার কারনে যথেস্ট সেন্সিবল বিহেভ করেছে৷ 


এবার আসল কথায় আসি। 


সত্যি বলতে,  আমরা যতই মেধা ও পরিশ্রমের কথা বলি না কেনো,  ব্যাকগ্রাউন্ড সাপোর্ট লাগেই। 


সাপোর্ট পায় বলেই  সমান যোগ্যতায় কেউ দেশের বাইরে পড়তে যায়  আর কেউ  দেশে আন্ডারপেইড জব করে। 


আর বিসিএস বা সরকারি সেক্টরের যে অবস্থা তা আর কী বলবো?   আমার দুদকে চাকরির ৮ মাসের বেতন উঠে যাবে।  মাস্টার্সটাও এর মধ্যে শেষ করে ফেলেছি।  কিন্তু,  ১ম বিসিএসের  ভাইভাই দিতে পারলাম না।  ( একটা বিসিএস ক্যান্ডিডেট অর্ধেক পাগল হয়ে যায় এই কারনে)  


আর্থিক ভাবে ব্যাকড আপ না হলে কীভাবে সম্ভব দেশের সবচাইতে প্রিমিয়াম বা প্রিমিয়ার লেভেলের এক্সামে নিজেকে  টিকিয়ে রাখা?  

বিসিএসে ভালো করার সক্ষমতা রাখা বহু ছেলে প্রাইভেট ব্যাংকে সূর্যের আলোহীন জীবন কাটাচ্ছে৷ 


এবার কাউন্টার লজিক হলো -  টাকা অনেকেরই আছে কিন্তু কজনের ভালো সিজিপিএ উঠে বা স্কিল ডেভেলাপ করতে পারে বা কজনই বা দেশে সরকারি সার্ভিসের প্রিমিয়াম সেগমেন্টে জহ পায়। 

কাউন্টার লজিকটাও ১০০% সত্যি। 


কিন্তু,   GIS শিখতে, প্রোগ্রামিং শিখতে একটা ভালো কম্পিউটার লাগে।  বিসিএস দিতে চাইলে দীর্ঘ সময় ফিল্ডে পড়ে থাকা লাগে । টাকা ছাড়া কিছুই সম্ভব না।  কেউ প্রিভিলেজ কাজে লাগাতে পারে,  কেউ পারে না।  প্রিভিলেজ কাজে লাগানোটাও বড় ক্রেডিট কিন্তু এটা  আফ্রিকান কোনো দেশের এথলেটদের অলিম্পিক এথলেটিক্সের ১১০ মিটার হার্ডল জেতার মত কিছু না।  


অবশ্যই,  অর্থনৈতিক সমর্থনই একটা মানুষকে এগিয়ে দেয়। 


ঠিক এই কারনেই সেকেন্ড টাইম বন্ধের পর ঢাবিতে ঢাকা ভিত্তিক ছেলে মেয়ে বেশি।  আমার জুনিয়র ব্যাচ গুলোতে দেখেছি তুলনামূলক ভাবে আর্থিক ভাবে সক্ষম পরিবারের ছেলে মেয়ে বেশি।  


যার মেধা আছে সে আগাবেই আমরা ধরে নেই৷ কিন্তু যে ছেলেটার ক্যাডার সার্ভিসে শাইন করার কথা সে দ্রুত চাকরির আশায় প্রাইভেট  ব্যাংকে কাজ করে পরিবারের দিকে তাকিয়ে বা যে ছেলেটার উচ্চ শিক্ষায় বাইরে যাবার কথা সে এঞ্জিওতে  অতিরিক্ত কাজের চাপে দিশেহারা।  সে ছেলেটা বা মেয়েটা আগাতে পারলেও তাদের সম্ভাবনার পুরোটা অর্জন করতে পারলো না৷  


**জগত ভয়ংকর ভাবে আনফেয়ার।  এটা আমি,  আপনি মেনে নিতে না চাইলেও ভয়ংকর রকমের সত্যি।


লিখেছেন -

আকিব রায়হান 

সহকারী পরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)

Post a Comment

0 Comments